ঢাকার সাভারে সব শ্রেণির মানুষের মুখে এখন তাঁর নাম। তরুণ ব্যবসায়ী রঞ্জিত ঘোষ। ওএমএসের চাল কিনতে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন, টাকা লাগছে না। বিনামূল্যে চাল নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। ইফতারের আগ মুহূর্তে কর্মহীন অসহায় রোজাদার হাজার মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে উন্নত মানের খাবার। এ ছাড়া চাল, ডাল, লবণ, চিনি, আলু, পেঁয়াজসহ ১৪ আইটেমের নিত্যপণ্যের ১১ কেজি ওজনের খাবার সামগ্রী পৌঁছে যাচ্ছে বাড়ি বাড়ি।
প্রচারের আড়ালে থেকে মানবতার জন্য নীরবে এভাবে কাজ করে যাওয়া ব্যবসায়ী রঞ্জিত ঘোষ এখন হয়ে উঠেছেন সাভারে ব্যবসায়ীদের আইকন। মানবতার অনন্য প্রতীক।
ধরা যাক ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা জুলেখা বেগমের কথা।
বেশ কষ্টে ১০০ টাকা জমিয়ে ১০ টাকা কেজি দরে খোলা বাজারের চাল কিনতে ট্রাকের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু চাল নিয়ে টাকা দিতে গিয়েই চমকে ওঠেন তিনি।
না টাকা দিতে হবে না!
ক্যান বাবা?
আপনি একা নন। এই লাইনে যারা দাঁড়িয়েছে সবার চালের টাকাই একজন ব্যবসায়ী আগাম পরিশোধ করে দিয়েছেন। ওএমএসের ট্রাকে থাকা ডিলারের এক কর্মীর মুখে এমন কথা শুনে আবেগে দু চোখ ছল ছল করে উঠেছিল জুলেখা বেগমের।
মনের অজান্তেই অদৃশ্য থাকা সেই ব্যবসায়ীর জন্য বুক ভরে দোয়া করলেন তিনি।
কেবল জুলেখা বেগম একা নন তাঁর মতো অসংখ্য অসহায় মানুষের কাছে এখন নয়ন মনি সেই ব্যবসায়ী।
প্রচারের আড়ালে থাকা সাভারের তরুণ ওই ব্যবসায়ীর নাম রঞ্জিত ঘোষ।
পৌর এলাকার ঘোষপাড়ার বীরেন কুমার ঘোষের ছেলে রঞ্জিত ঘোষ মানবতার টানে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে রীতিমতো শোরগোল ফেলে দিয়েছেন সাভারে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির মধ্যে কর্মহীন মানুষকে সহায়তা দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দেশব্যাপী চালু হওয়া ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির বিশেষ ওপেন মার্কেট সেল (ওএমএস) বা খোলাবাজারে চাল বিক্রির খাদ্যবান্ধব কার্যক্রম হাতে নেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়।
করোনা পরিস্থিতির কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমজীবী কিংবা দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত যারা আগে সরকারের কোনো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সুবিধা গ্রহণ করেননি সাভার পৌর এলাকায় বিভিন্ন ওয়ার্ডে ইতোমধ্যে এমন ২ হাজার ২০০ পরিবারে মাথাপিছু ১০ টাকা কেজি দরের চালের পুরো টাকা পরিশোধ করে দিয়েছেন এই ব্যবসায়ী।
কেবল ওএমএসের চালই নয়, এরই মধ্যে ১৫ হাজার মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন চাল, মসুর ডাল, ছোলা, আলু, পেঁয়াজ, লবণ, চিনি, তেল, হুইল পাউডার, সাবানসহ ১৪ আইটেমের বিশেষ উপহার।
এ ছাড়া প্রতিদিন এক হাজার শ্রমজীবী দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত রোজাদারদের জন্য ইফতারে পরিবেশন করছেন উন্নত মানের তৈরি খাবার।
আর কে এন্টারপ্রাইজ, আর কে জুয়েলার্স, আর কে ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, আর কে ইমিগ্রেশনের স্বত্বাধিকারী ব্যবসায়ী রঞ্জিত ঘোষের ব্যবস্থাপক সাইদুর রহমান বলেন, ‘মহামারি করোনার সূচনা থেকেই মানবতার জন্য আমরা কাজ করছি। পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের দিনেও বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমরা খাবার পৌঁছে দিয়েছি। প্রতিদিন ৫০ জনের বিশেষ একটি দল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ত্রাণসামগ্রী প্রস্তুত করে এবং আরেকটি দল তা বিতরণ করে। প্রকৃতপক্ষে আমার বস (রঞ্জিত ঘোষ) যা করছেন তা আড়ালে থেকেই করছেন। তিনি অত্যন্ত প্রচারবিমুখ একজন মানুষ। প্রচারের আলোতেও আসতে চান না।’
অবশ্য অনেক অনুরোধের পর সাইদুর রহমানের মাধ্যমে রঞ্জিত ঘোষ সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমদিকে নিজের মানবিক তৎপরতা নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতেও রাজি হননি।
যে দেশে রমজান এলে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যায়। পণ্য সংকটের সুযোগে যেখানে ব্যবসায়ীরা দাম চড়িয়ে সাধারণ জনসাধারনের ভোগান্তির মধ্যে ফেলেন। ব্যবসায়ীদের প্রতি বাণিজ্যের কারণে হরহামেশাই যেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করতে হয় সেখানে তাঁর এই কার্যক্রম যেন অন্য এক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। যা অনেকের জন্য হতে পারে অনুকরণীয়। এটা জানানো হলে পরে তিনি সরাসরি কথা বলতে সম্মত হন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে।
ব্যবসায়ী রঞ্জিত ঘোষ বলেন, ‘দেখুন, আমি কোনো কিছুর লক্ষ্য নিয়ে এই কাজগুলো করছি না। আমি যা করছি তা সামান্য কিছু মানুষের উপকারে আসছে এবং তা মহান সৃষ্টিকর্তা দেখছেন। সেটাই যথেষ্ট। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, তিনি আমাকে এ কাজগুলো করার সুযোগ দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে কজনই বা মানবতার পক্ষে এ ধরনের কাজ করার সুযোগ পায় বলুন। আমার কাছে মানবতাই সবার আগে। আমার জায়গা থেকে আমি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছি। এর মাধ্যমে যে পার্থিব আনন্দ এবং সুখ আমি পেয়েছি তা আবার সম্পদের তুলনায় একেবারেই তুচ্ছ।’
আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, পবিত্র রমজান মাসজুড়েই শ্রমজীবী দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত রোজাদারদের ইফতারে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন অব্যাহত রাখব। পাশাপাশি অব্যাহত থাকবে আমার অন্যান্য সব ধরনের মানবিক সহযোগিতা।’ যোগ করেন এই ব্যবসায়ী।
রঞ্জিত ঘোষের এই মানবিক কার্যক্রমে সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিরা।
যোগাযোগ করা হলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান এমপি বলেন, ‘ব্যবসায়ী রঞ্জিত ঘোষ সত্যিকারের মানবতার দিশারী। তিনি ব্যবসায়ীদের চোখ খুলে দিয়েছেন। সবাই যখন মুনাফার কথা ভাবেন তখন তিনি ব্যতিক্রম। নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন মানবতার কল্যাণে। এই রঞ্জিত ঘোষরাই বাংলাদেশের আসল হিরো।’